বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১২:০৪ অপরাহ্ন

ভারত ভাগের সময় যেভাবে বিশ্বযুদ্ধের বিমান কাজে এসেছিল

ভারত ভাগের সময় যেভাবে বিশ্বযুদ্ধের বিমান কাজে এসেছিল

স্বদেশ ডেস্ক:

ভারত ও পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী বিভাজন নিয়ে রচিত তমস (আঁধার) উপন্যাসে লেখক ভিস্ম সাহনি একটি হিংসা-বিধ্বস্ত গ্রামের বদলে যাওয়ার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যে গ্রামটির ওপর দিয়ে একটি বিমান তিনবার চক্কর কেটে গেল।

ওই উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে।

‘মানুষজন বেরিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে যেন মারামারি-কাটাকাটি শেষ হয়ে গেছে, আর এখন লাশগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। সবাই তাদের বাড়িতে ফিরে গিয়ে নিজেদের জামাকাপড় আর অস্ত্রশস্ত্রের কত কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেই হিসাব মেলাতে বসল।

উপমহাদেশকে ভাগ করে দুটো স্বাধীন দেশ- ভারত আর পাকিস্তান হওয়ার পরে যে গণহত্যা হয়েছিল, তারই একটা কাল্পনিক বিবরণ লিখেছিলেন ভিস্ম সাহনি। দেশভাগের পরে যে ধর্মীয় দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তা প্রায় দশ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, ছিন্নমূল হয়েছিলেন এক কোটি কুড়ি লাখ মানুষ।

ভারতের স্বাধীনতা ও বিমানের গুরুত্ব
ইতিহাসবিদ আশিক আহমেদ ইকবাল বলছেন, গ্রামগুলির ওপর দিয়ে এই বিমানের উড়ে যাওয়ার কাহিনীতে সম্ভবত বাস্তবের প্রতিফলন ঘটেছিল।

বিমানের উপস্থিতিই একদিক থেকে হিংসা ছড়ানোর ক্ষেত্রে একটা বাধা হয়ে উঠেছিল। বিমানের উড়ে যাওয়ার ফলে ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত আর গ্রামের মানুষ প্রতিরোধ করার সময় পেত।

‘দ্য এরোপ্লেন অ্যান্ড দ্য মেকিং অফ মডার্ন ইন্ডিয়া’ বইতে ইকবাল লিখেছেন, ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে ভারত আর পাকিস্তান এই দুটি স্বাধীন দেশ তৈরির সময়ে বিমানগুলি একটা ছোট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছিল।

ভারত ও পাকিস্তান থেকে যে এক কোটি কুড়ি লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়ে অন্য দেশে পালিয়েছিলেন, তাদের সিংহভাগই রেলে, গাড়িতে বা গরুর গাড়িতে অথবা পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। ইকবাল বলছেন, হাজার পঞ্চাশেক মানুষ, মোট ছিন্নমূল হওয়া মানুষের এক শতাংশেরও কম, তাদের এক সরানো হয়েছিল বিমানে করে।

নাগরিকদের দেশ বদল ১৯৪৭ -এর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর, মাত্র তিন মাসের মধ্যেই মোটামুটিভাবে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।

উদ্বাস্তুদের ওপরে আকাশপথে নজরদারি
ব্রিটিশ ভারতের বিমান বাহিনী বা রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স দেশভাগের সময় বিশৃঙ্খলা থামাতে আর উদ্বাস্তুদের সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, লিখেছেন ইকবাল।

প্রতিদিন সকালে বিমানগুলো ‘মিশনে’ উড়ত। উদ্বাস্তুদের ট্রেনগুলোকে জনতার সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে যেমন রক্ষা করত এই বিমানগুলো, তেমনই আবার কোনো নাশকতা ঘটিয়ে লাইনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি কেউ করেছে কি না, তার ওপরেও নজরদারি চালাত।

পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে ওড়ার সময়ে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি বিমানের নজরে আসে এক অদ্ভুত দৃশ্য। প্রায় ৩০ হাজার উদ্বাস্তু পায়ে হেঁটে সীমান্তের দিকে এগোচ্ছিলেন। উদ্বাস্তুদের ওই মহা-মিছিলটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল, লিখেছেন ইকবাল।

ওই বিমানগুলো আবার উদ্বাস্তুদের আক্রমণ করার জন্য ওঁত পেতে থাকা সশস্ত্র জনগোষ্ঠীগুলিকেও খুঁজে পেয়ে টহলরত সেনাসদস্যদের সতর্ক করে দিয়েছে। বিমানগুলো নিচু দিয়ে ওড়ার সময়ে জ্বলে-পুড়ে যাওয়া গ্রামগুলি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে সেই বিবরণ রেকর্ড করেছে, আবার পাঞ্জাবের খালগুলিতে লাশ ভেসে যেতেও দেখা গেছে বিমান থেকে।

তবে বিমানের ভূমিকা এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আরআইএএফের বিমানগুলো মূলত বহু-পরীক্ষিত ডাকোটা বিমানের বহর, দিল্লি থেকে করাচিতে কলেরার ওষুধের ১৫ লাখ ডোজ পৌঁছিয়ে দিয়ে এসেছিল যাতে অস্বাস্থ্যকর শরণার্থী শিবিরগুলোতে মহামারী ছড়িয়ে না পড়ে। বিমান থেকে শরণার্থীদের জন্য রান্না করা খাবার, চিনি ও তেলও ফেলা হতো।

ইকবাল লিখেছেন, ভারত আর পাকিস্তান উভয় দেশই এই বিমানগুলো ব্যবহার করেই লিফলেট ছড়িয়ে দিয়ে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য দাঙ্গাকারীদের সতর্কবার্তা দিত।

আবার আরআইএএফ পাকিস্তানের দূরবর্তী অঞ্চল, যেমন মুলতান, বান্নু বা পেশোয়ারের মতো এলাকায় আটকে পড়া অ-মুসলিমদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে এসেছে।

তালেবান ২০২১ -এর আগস্টে আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার পরে দেশ ছেড়ে পালাতে মরিয়া আফগানরা যেভাবে কাবুল বিমানবন্দরে সামরিক বিমানগুলোর পাশে দৌড়াতেন বা বিমানগুলো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতেন, দিল্লি ও পাঞ্জাবের বিমানবন্দরগুলোতেও ১৯৪৭ সালে অনেকটা সেরকমই মরিয়া প্রচেষ্টার ছবি দেখা যেত।

বিমানে চড়তে ঘুষ
ইকবাল লিখেছেন, এয়ারস্ট্রিপের কাছাকাছি শিবিরে বসবাসকারী শরণার্থীরা অনুমতি পেলেই বিমানের দিকে দৌড় লাগাতেন। বিপদ থেকে পালানোর জন্য মরিয়া যাত্রীরা বিমানে ওঠার জন্য বিমানকর্মীদের সোনা আর নগদ অর্থ ঘুষও দিতেন।

টিকিটের দাম ছিল অনেক বেশি। যাত্রীদের খুব কম মালামাল নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো। হায়দ্রাবাদ থেকে পাকিস্তানে যাওয়া এক নারী যাত্রীর বর্ণনা আছে, যিনি শুধু কোরআন নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, বা আরেক দল যাত্রী বাচ্চাদের একটা ভাঙ্গাচোরা বেতের চেয়ার বা কেউ একটা অসুস্থ টিয়াপাখি নিয়ে বিমানে উঠেছেন, সেই বর্ণনাও আছে।

আশ্চর্যের কিছু নেই যে প্লেনগুলো কানায় কানায় ভর্তি থাকত। আসন আর কার্পেট সরিয়ে দেয়া হয়েছিল যাতে যত সম্ভব তত যাত্রী তোলা যায়। ডাকোটা ডিসি-৩ প্লেনগুলোর ধারণক্ষমতা ছিল ২১ জন, কিন্তু কখনো তার থেকে পাঁচগুণ বেশি লোকও নিয়ে উড়ত বিমানগুলো।

একটি বেসরকারি বিমান সংস্থার একজন প্রযুক্তিবিদকে পাইলট তার মুঠিতে পরার জন্য একটা ধাতব ‘পাঞ্চ’ দিয়েছিলেন যা দিয়ে তিনি ভিড় সামলাতে পারেন।

তিনি ঘুষি মারতে মারতে বিমানের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেন বিমানটির নিচের অংশের পিনগুলো সংগ্রহ করে দরজা শক্তভাবে এঁটে দিয়ে আবার ঘুষি মারতে মারতেই ফিরে আসতেন, লিখেছেন আশিক আহমেদ ইকবাল।

প্রচণ্ড ভিড়, বিমানের অত্যধিক ব্যবহার এবং বিমানবন্দরে দুর্বল নিরাপত্তা সত্ত্বেও যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তা এক আশ্চর্যের বিষয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফেলে যাওয়া বিমান
দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে বিমান নামার আগেই রানওয়েতে উদ্বাস্তুদের ভিড় লেগে যেত। কিন্তু ‘অন্য দেশ’-এর বিমানকর্মীদের সাথে প্রশাসন খুব একটা সহযোগিতা করত না, তাদের সাহায্যে এগিয়েও আসত না।

ভারতে, ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে ১১৫টি বেসামরিক বিমান ছিল, যেগুলি ১১টি বেসরকারি সংস্থা চালাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অসামরিক বিমান পরিবহনে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি হয়, কারণ মার্কিন বিমানবাহিনীর ছেড়ে যাওয়া ডগলাস ডিসি-৩ ডাকোটা বিমানগুলো ভারতীয় কোম্পানিগুলো সস্তায় কিনে নিয়েছিল।

কিন্তু বিমানের যোগান থাকলেও তেমন চাহিদা ছিল না, তাই লাভও হতো কম।

যেসব বেসামরিক বিমান নির্দিষ্ট রুটে উড়ছিল না, সেগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছিল দেশভাগের সময়ে পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তুদের পরিবহনের জন্য। এগুলোর মধ্যে দশটি বিমান সরকারকে ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়।

কিন্তু বেসামরিক বিমান পরিচালনাকারীরা এই ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযানের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি।

এই ‘অসম্ভব কাজটি’র জন্য তারা নিজেদের বিমান আর বিমানকর্মীদের জীবনের ঝুঁকি নিতে অস্বীকার করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে সাহায্য চাওয়া হয়।

ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারওয়েজ কর্পোরেশনের ২১টি বিমান ১৫ দিন ধরে দিনরাত উড়ে ৬৩০০ জনকে দিল্লি থেকে করাচি পৌঁছিয়ে দেয়। এই বিমানগুলো ৪৫ হাজার কিলোগ্রাম খাদ্য সামগ্রী, তাঁবু এবং টিকা নিয়ে আসে দিল্লি বিমানবন্দরে আটকিয়ে পড়া মুসলিম শরণার্থীদের জন্য।

যুক্তরাজ্য থেকে আনা হয় কর্মী
ব্রিটিশ নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য রয়্যাল এয়ার ফোর্সের যে দুটি বিমান কাজে লাগানো হয়েছিল, সেগুলি দিয়েই আবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১২ হাজার মানুষকে পরিবহন করা হয়।

আশিক আহমেদ ইকবাল লিখেছেন, এদের মধ্যে মাত্র ২৭৯০ জন ছিলেন ব্রিটিশ কর্মচারী, বাকিরা ছিলেন রেলওয়ে, ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগের কর্মচারী, নাগরিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে যাদের মাঠ পর্যায়ে গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।

এই প্রচেষ্টা যে যথেষ্ট নয়, সেটা ১৯৪৭ সালের অক্টোবরেই বুঝতে পেরেছিল ভারত।

এরপর শুরু হয় ‘অপারেশন ইন্ডিয়া।’
অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে, আটটি ব্রিটিশ সংস্থার কাছ থেকে ২১টি ডাকোটা বিমান লিজ নেয়া হয়েছিল। এগুলির মাধ্যমেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ আর ১৫ লাখ পাউন্ড ওজনের যাত্রীদের মালপত্র পরিবহন করা হয়েছিল। এই কাজের জন্য ১৭০ জন কর্মীকে যুক্তরাজ্য থেকে ভারতে আনা হয়েছিল।

ভারতের বিমান সংস্থাগুলো অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হচ্ছিল, তাই দুই সরকারকেই ব্রিটিশ সংস্থার বিমান ভাড়া করে আনতে হয়েছিল।

বিমান ব্যবহার করার ফলে স্বাধীনতার পরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক মাসের মধ্যেই স্বাধীন ভারত গঠনের কাজ দ্রুততর করা গিয়েছিল, লিখেছেন আশিক আহমেদ ইকবাল।
সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877